হৃদরোগ বলতে মূলত হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন ধরণের সমস্যা বোঝায়। হৃদরোগের অধিক লক্ষণীয় সমস্যা হল করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD),যা আমাদের কাছে সাধারনত হার্ট ব্লক নামে পরিচিত। হার্টে ব্লক হলে আমাদের হৃদযন্ত্রে রক্ত প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হয়ে হার্টে রক্ত প্রবাহ কমে যায়। আর হার্টে রক্ত প্রবাহ কমে গেলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
হার্ট ব্লক কীঃ
আমাদের সারা দেহে ছড়িয়ে আছে দুই ধরনের রক্তনালিঃ ধমনী ও শিরা। ধমনীর কাজ হল অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত হৃৎপিণ্ড থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয়া। ধমনীর প্রবাহপথ কোন কারণে সরু বা বন্ধ হয়ে গেলে হৃদযন্ত্রে রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়, এই বাধাকে "হার্ট ব্লক" বলে।
হার্ট ব্লক কেন হয়ঃ
ধমনীতে ব্লকের মূল কারণ কোলেস্টেরল যা আমাদের প্রতিদিনের খাবারের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে এবং রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে ধমনীর ভেতরের গায়ে জমা হয়ে ব্লকের সৃষ্টি করে।
হার্ট ব্লক এর কারণ গুলো কি কিঃ
- অলস জীবন যাপন
- পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব
- মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা
- ধুমপান
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
- রাত জেগে কাজ করা
- দীর্ঘ সময় বশে কাজ করা
- অতিরিক্ত ওজন বা মেদ
হার্ট ব্লক এর রিস্ক ফেক্টর গুলো কিঃ
হার্ট ব্লক এর কারণ সাধারণ কারণগুলো ছাড়াও অন্যান্য কিছু Risk Factor আছে যা হার্ট ব্লক হবার সম্ভাবনা গুলো বাড়িয়ে দেয়ঃ
- ৪০ বছরের বেশি বয়স হওয়া
- বংশের কারো হার্ট ব্লক থাকা
- উচ্চ রক্ত চাপ থাকা
- ডায়াবেটিস থাকা
- মানসিক রোগী
- মহিলাদের জন্ম নিয়ন্ত্রনের ওষুধ সেবন
- মহিলাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস
হার্ট ব্লক হয়েছে কি না কীভাবে বুঝবেনঃ
করোনারি ধমনীতে ব্লক থাকলে সাধারণত নিচের উপসর্গগুলো দেখা যায়-
- বুকের বামপাশে বা মাঝখানে এক ধরনের ব্যথা বোধ হয়।
- অনেক সময় বাম হাতের ভেতরের দিকে অস্বস্তি বোধ হয়।
- নিচের চোয়ালে বা দাঁতের পাশেও এক ধরনের অস্বস্তি অনুভূত হওয়া।
প্রাথমিক অবস্থায় কেবল শারীরিক পরিশ্রমের সময় এই ব্যাথা অনুভূত হয় এবং বিশ্রাম নিলে কমে যায়। তবে মনে রাখতে হবে যে, ব্লক থাকলেই যেসব সময় ব্যাথা হবে, এমন নয়; অনন্যা অনেক কারণেই বুকে ব্যথা বা শারীরিক অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে।
ব্লক থেকে হার্ট অ্যাটাকঃ
হার্টে ব্লক থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত চিকিৎসা না নিলে তা হার্ট অ্যাটাকের দিকে মোড় নিতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের ফলে হৃৎপেশি মারা যেতে শুরু করে বলে বুকে তীব্র ব্যথার সঙ্গে বমি ও প্রচুর ঘাম হয়। হার্ট অ্যাটাক খুবই মারাত্মক এক পরিণতি যা প্রায়ই রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
হার্ট ব্লকের চিকিৎসাঃ
হার্ট ব্লক যতই বিপজ্জনক হোক না কেন, দশটি রোগের মতো এরও চিকিৎসা রয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় ওষুধের মাধ্যমে ব্লকের চিকিৎসা সম্ভব। মারাত্মক ব্লকের ক্ষেত্রে প্রথমে অ্যানজিওগ্রাম পরীক্ষা করে ব্লকের স্থান ও তীব্রতা নির্ধারণ করতে হবে। তারপর সম্ভব হলে চিকিৎসক হার্টে রিং বসিয়ে ব্লক দূর করার চেষ্টা করেন। ব্লকের সংখ্যায় বেশি হলে, রিং বসানো ফলদায়ক নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসক বাইপাস অপারেশনের মাধমে হার্টের ব্লক দূর করতে পারেন।
ব্লকমুক্ত হার্ট! কীভাবেঃ
ধমনীর ভেতরে চর্বি জমা হওয়ার পেছনে কারণ মূলত ৪টিঃ
-উচ্চ রক্তচাপ
-ডায়াবেটিস
-ধূমপান
-রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া
সুতরাং, হার্টকে ব্লকমুক্ত রাখতে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ ও ধূমপান পরিহার করা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য চাই দৃঢ় মনোবল, ইচ্ছা শক্তি এবং জীবনাচরণে পরিবর্তন।
শারীরিক পরিশ্রম বাড়ানো
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও উচ্চ কোলেস্টেরলের ঝুঁকি কমায়।
লিফট কম ব্যবহার করুন
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা কিংবা জগিংয়ের অভ্যাস করুন। যারা হাঁটার সময় বের করতে পারেন না, তারা কাছের দূরত্বগুলো যানবাহন ব্যবহার না করে পায়ে হেঁটে যান। যতটা সম্ভব লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার করুন।
ক্যালরির হিসাব রাখুন
খাবারের মাধ্যমে প্রতিদিন যে পরিমাণ ক্যালরি আপনি গ্রহণ করছেন, সেই পরিমাণ ক্যালরি যদি খরচ না হয়, তাহলে বাড়তি ক্যালরি রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ওজন বাড়িয়ে আপনাকে ডায়াবেটিস ও হার্ট ডিজিজের দিকে ঠেলে দেবে। এজন্য প্রতিদিন খাবারের মাধ্যমে গৃহিত ক্যালরি ও এর ব্যয় সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা মাথায় রাখা ভালো।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি কমাতে নিচের খাবারগুলো আপনার দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন।
-টাটকা শাকসব্জি, ফলমূল
-মাছ- বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ
-বিভিন্ন ধরনের বাদাম (নাটস্), শিম, মটরশুঁটি
-সয়াজাত খাবার যেমন-তফু
-রসুন
-ননিমুক্ত দুধ, পনির
কিছু খাবার পরিহার করাও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের অংশ। এ ধরনের কিছু খাবার হল-
-অতিরিক্ত লবণ
-লাল মাংস ও অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মাংস যেমন- গরু, খাসি, হাঁস ইত্যাদি
-মাংসের ওপরের চামড়া
-মাখন
-অধিকাংশ কোমল পানীয়
-অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার
তামাককে "না" বলুনঃ
সিগারেটের সঙ্গে অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্য যেমন- গুল, জর্দা ইত্যাদি গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। পরোক্ষ ধূমপানের ব্যাপারেও সতর্ক থাকুন।
মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকার অভ্যাস করুনঃ
দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ আপনার রক্তচাপ ও হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। সুতরাং যতটা সম্ভব মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। বুক ভরে শ্বাস নিন এবং সুযোগ পেলেই হাসুন, প্রাণখুলে। মানসিক প্রশান্তির জন্য নামাজ, প্রার্থনা, মেডিটেশন করুন।
নিয়মিত চেক-আপঃ
হার্টের ব্লক সাধারণত বয়স্কদের রোগ হলেও ইদানীং অল্প বয়সেও এ রোগ দেখা যাচ্ছে। তাই ব্লকজনিত হৃদরোগ প্রতিরোধে ৪০ বছর বয়সের পর নিয়মিত চেক-আপ করানো ভালো।
হৃদরোগ এর আদ্যোপান্ত - কারন, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
স্বাস্থ্য কথা